নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় পরকীয়া প্রেমে বাঁধা দেয়ায় স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক কর্তৃক স্বামী মনসুরকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্যকর এবং ক্লুলেস মামলার আত্মগোপনকারী মূল আসামী জাহাঙ্গীরকে ঢাকা জেলার সাভার থানার হেমায়েতপুর থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩।

১। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর শাহজাহানপুরে টিপু হত্যা, বহুল আলোচিত বিশ^জিৎ হত্যা, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে গলা কেটে অটোরিকশা চালক হত্যা, পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলায় ইউপি সদস্য মামুন হাওলাদারকে হত্যা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাÐের প্রধান সমন্বয়কারী ও ইন্টারপোল কর্তৃক রেড নোটিশ জারিকৃত মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত, রমনা থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি হত্যা, পরকীয়া প্রেমে বাঁধা দেয়ায় শ্বাশুড়িকে নৃশংসভাবে হত্যাসহ বিগত ০৩ বছরে সর্বমোট ওয়ারেন্টভুক্ত, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এবং মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৯টি অভিযান পরিচালনা করে ৩১৫ জন আসামীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

২। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৩ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ গভীর রাতে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় পরকীয়া প্রেমে বাঁধা দেয়ায় স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক কর্তৃক স্বামী মনসুরকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্যকর এবং ক্লুলেস মামলার আতœগোপনকারী মূল আসামী ১। মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (২৯), পিতা-মোঃ মোজাহার মন্ডল, সাং-কালিকাপুর, থানা-মান্দা, জেলা-নওগাঁকে ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন হেমায়েতপুর এলাকা হতে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

৩। ধৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, মৃত মনসুর রহমান নওগাঁ জেলার মান্দা এলাকার বাসিন্দা এবং ধৃত জাহাঙ্গীর তার পাশের গ্রামের বাসিন্দা। মৃত মনসুর তার এলাকার বিভিন্ন দোকানে চানাচুর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। মনসুর দুইটি বিয়ে করে এবং দুই স্ত্রী সহ নিজ বাড়িতে বসবাস করত। মূলত মৃত মনসুরের প্রথম স্ত্রী হাসিনার সাথে বনিবনা না হওয়ায় সে মেঘনা নামে এক মেয়েকে ২য় বিয়ে করে। তার প্রথম স্ত্রী হাসিনা এলাকার বিভিন্ন পুরুষের সাথে পরকিয়া প্রেমে লিপ্ত ছিল। সর্বশেষ হাসিনা পাশের গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের সাথে পরকিয়া প্রেমে জড়ায় এবং মনসুরের অনুপস্থিতিতে মেলামেশা করতে থাকে। এভাবেই ঘটনার দিন সন্ধ্যায় মনসুরের নিজ বাড়িতে জাহাঙ্গীরসহ তার আরো কয়েকজন বন্ধু হাসিনার সাথে দেখা করতে আসে। বন্ধুদের পাশের ঘরে বসিয়ে হাসিনা এবং জাহাঙ্গীর মনসুরের শয়নকক্ষে সময় কাটানোর এক পর্যায়ে মনসুর এসে তার স্ত্রীকে অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখে জাহাঙ্গীরের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। এমন সময় জাহাঙ্গীরের বন্ধুরা মনসুর এবং জাহাঙ্গীরের মধ্যে চলমান বিবাদ মিমাংসার কথা বলে মনসুরকে বাড়ির পাশের একটি বাগানে নিয়ে যায়। এই ঘটনার সময় মনসুরের ২য় স্ত্রী মেঘনা জাহাঙ্গীর এবং মনসুরকে বাড়ি থেকে বাগানের দিকে চলে যেতে দেখে ঘরের ভিতর চলে আসে।

৪। মূলত এ ঘটনাটির পেছনে সাহেব আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর সহ অপরাপর কয়েকজন মিলে একটি নীলনকশা সাজিয়েছিল। সেই নীলনকশা অনুযায়ী মনসুরের বাড়িতে এসে হাসিনার সাথে মেলামেশা করে মনসুরকে উস্কে দিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মনসুরকে বাগানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটি পূর্ব থেকেই সুচারুভাবে সাজানো ছিল। এ ঘটনার পেছনের মূল কারিগর ছিল মাস্টারমাইন্ড এক অপরাধী এবং কাকতালীয়ভাবে তার নামও জাহাঙ্গীর। তার পিতার নাম মোজাহার, গ্রাম-কালিকাপুর। ঘটনাস্থানে উপস্থিত বন্ধুদের মধ্যে পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর ছিলনা। সে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বাগানে অপেক্ষা করতে থাকে। উল্লেখ্য যে, এই জাহাঙ্গীরের সাথেও কিছুদিন পূর্বে হাসিনার পরকিয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং মনসুর বিষয়টি জেনে যাওয়ায় তার সাথে দ্ব›েদ্বর কারণে হাসিনা এবং জাহাঙ্গীরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে হাসিনা সাহেব আলীর ছেলে জাহাঙ্গীরের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। পূর্ববর্তী প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মোজাহারের ছেলে জাহাঙ্গীর অন্যান্যদের নিয়ে ১১ নভেম্বর ২০২২ তারিখ তার নিজ বাড়িতে বসে মনসুরকে হত্যার এই নীলনকশাটি সাজায়। তবে কৌশলে সে অপরাপর জাহাঙ্গীর যার সাথে হাসিনার বর্তমানে পরকিয়ার সম্পর্ক চলমান তাকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরে নিজেকে আড়ালে রাখে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা দুই তিনদিন যাবৎ মনসুরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং ১৫ নভেম্বর সুযোগটি কাজে লাগাতে সক্ষম হয়।

৫। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর জানায় যে, ঘটনার সময় সে বাগানে অপেক্ষারত ছিল। বাকীরা মনসুরকে বাগানে নিয়ে যাওয়ার পর তার নেতৃত্বে সকলে মিলে ঘটনাস্থলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাখা বাঁশ এবং গাছের ডাল দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। পেটানোর একপর্যায়ে মনসুর মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকে। এমন সময় জাহাঙ্গীর তাকে মুখমন্ডলে লাথি দিলে মনসুর গোঙরাতে শুরু করে। সে মারা যায়নি দেখতে পেয়ে জাহাঙ্গীরের প্রচন্ড রাগ হয় এবং একপর্যায়ে অন্যান্যদের সহযোগিতা নিয়ে জাহাঙ্গীর তার মাফলার দিয়ে মনসুরের গলায় পেঁচিয়ে গাছের ডালের সাথে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মনসুরের মৃত্যু নিশ্চিত করার পর জাহাঙ্গীর ও তার অপরাপর সহযোগিরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।

৬। ঘটনার পরদিন সকালে মৃত মনসুরের ২য় স্ত্রী মেঘনা খোঁজাখুজির একপর্যায়ে বাগানে ঝুলন্ত অবস্থায় মনসুরের মরদেহটি আবিষ্কার করে। যেহেতু সে রাতে তার স্বামীর সাথে জাহাঙ্গীরকে একসাথে বের হতে দেখে সেহেতু জাহাঙ্গীরকে মূল হত্যাকারী হিসেবে সনাক্ত করা হয়। উক্ত ঘটনায় ১৭ নভেম্বর নওগাঁ জেলার মান্দা থানায় মৃত মনসুর এর বাবা মোঃ বদের আলী ওরফে বুদু কবিরাজ বাদী হয়ে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, পিতা-মোঃ সাহেব আলী, সাং-চক কালিকাপুর, থানা-মান্দা, জেলা-নওগাঁ এবং অজ্ঞাত ৪/৫ জনের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এই মামলায় উক্ত জাহাঙ্গীরকে আসামী করা হলেও হত্যাকান্ডটির মূল পরিকল্পনাকারী এবং মনসুরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিতকারী ধৃত আসামী জাহাঙ্গীরের (মোজাহারের ছেলে) নাম মামলায় আসেনি। সে পরিকল্পনাটির পেছনে থেকে হত্যাকান্ডটি ঘটিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেকে আড়াল করতে সক্ষম হয় এবং তারই সাজানো নাটক অনুযায়ী এই হত্যাকান্ডের তার সহযোগী জাহাঙ্গীর (সাহেব আলীর ছেলে) মূল আসামী বলে পরিগণিত হয়। হত্যাকান্ডটি ঘটার পর প্রাথমিকভাবে মাস্টারমাইন্ড জাহাঙ্গীরের সম্পৃক্ততার বিষয়টির কোন ক্লু না থাকায় তাকে সন্দেহের আওতায় আনা হয়না। কিন্তু পরবর্তীতে গভীর তদন্তে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে।

৭। ধৃত আসামী এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। পরবর্তীতে লেখাপড়া বাদ দিয়ে এলাকায় কৃষি কাজ এবং বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। ঘটনার পর সে বাড়ি থেকে পালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করতে থাকে। সে কোন স্থানে কাজ না পেয়ে ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন হেমায়েতপুর এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে আত্মগোপনে থাকতে শুরু করে। পরবর্তীতে সে হেমায়েতপুর এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত।

৮। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।